শ্রীললিতানন্দের লেখা গানগুলি ভক্তিসঙ্গীত। মরমিয়া সঙ্গীতজ্ঞ শ্রীদিলীপকুমার রায় তাঁর স্মৃতিচারণে ভক্তিসঙ্গীত প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। অন্যান্য গানের চেয়ে ভক্তিসঙ্গীতের রস বেশি গভীর। ভক্তিসঙ্গীতের আনন্দ মাধুরীসর্বস্ব সঙ্গীতের আনন্দের চেয়ে যুগপৎ ঊর্ধ্বতর, শুদ্ধতর, গভীরতর। তার সঙ্গে ওস্তাদি সঙ্গীতের আনন্দের তুলনাই হয় না। এ সঙ্গীত আমাদের প্রান-মন-অন্তরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ভগবানের দিকে। এ ক্ষেত্রে গুণী রুপান্তরিত হন পরম ভাগবতে। যে মুহূর্তে গুণী প্রেমতন্ময় হয়ে তাঁর গানকে ভোগের মতন ভগবানকে নিবেদন করেন, সে মুহূর্তে ভগবানও তাঁর প্রেমের ডাকে সাড়া দিয়ে সে ভোগ গ্রহণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে সে ভোগ হয়ে ওঠে প্রসাদ—যার মধ্যে ভগবৎস্পর্শে বেজে ওঠে এক অবর্ণনীয় দিব্য স্পন্দন। পক্ষান্তরে, যে গানের লক্ষ্য শ্রোতার চিত্তরঞ্জন বা যে গানকে সাধা হয় গুণীর নিজের শ্রবণমনের আত্মতৃপ্তির জন্যে তার মধ্যে হাজার বিস্ময়কর কারুকলা ফুটে উঠলেও সে থাকে মানবিক বিলাসবস্তু, প্রাণমনের সেব্য--- অন্তরাত্মার উপজীব্য হয়ে উঠতে পারে না। যার পরম কামনা সর্বস্ব ইষ্টকে নিবেদন করে ধন্য হওয়া, তার পক্ষে ভজন কীর্তনের আত্মহারা ভক্তির সুরকে আত্মার আত্মীয় বলে না মনে হয়েই পারে না, কেননা কীর্তনের লক্ষ্য হল হৃদয়ের সুন্দরতম নিবিড়তম সুরের অর্ঘ্য তাঁর চরণে পৌঁছে দেওয়া।
শ্রীললিতানন্দ নিজে গাইতেন মূলতঃ কীর্তন সুরে। তিনি গান ধরতেন, সেই সঙ্গে খঞ্জনী বাজাতেন আর সমবেত ভক্ত-অনুরাগীরা খোল করতাল সহযোগে দোহারকি করতেন। সে সময় ভক্তসঙ্গে তাঁর গাওয়া গানের কোন রেকর্ড করা হয় নি, সে জন্য তিনি কীভাবে গাইতেন সে ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়। ভক্তদের মধ্যে যাঁরা শাস্ত্রীয়-সঙ্গীত চর্চা করতেন তাঁরা গানে রাগ-ভিত্তিক সুরারোপ করে হারমোনিয়াম ও তবলা সহযোগে একক গান করতেন। সঙ্গীত-শিক্ষক শ্রীহারাণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীললিতানন্দের গানে সুরারোপ করে এককভাবে বেশ কিছু গান গাইতেন। ইনি তাঁর সমক্ষে গান গেয়েছেন এবং তাঁর তিরোধানের পরেও দীর্ঘদিন গেয়ে গেছেন বিভিন্ন জায়গায়, ছোট বড় নানা আসরে। গানগুলির মধ্যে কয়েকটির তিনি স্বরলিপি করেন যেগুলি “উত্তরণ” ও “আত্মবিকাশ” পত্রিকায় ছাপা হয় আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার দশক আগে। সেই স্বরলিপিগুলি আমরা প্রকাশ করলাম পাঠকদের সুবিধার্থে। এ ছাড়া কয়েকটি গানের অডিও/ভিডিও রেকর্ডিং প্রকাশ করে আগ্রহী পাঠকদের জানাতে চাই কীভাবে এই গান গাওয়া হয়ে থাকে। যদি কেউ তা গাইতে চান, তিনি এই স্বরলিপিগুলি বা অডিও/ভিডিও রেকর্ডিং থেকে গায়ন পদ্ধতির একটা ধারণা পাবেন। সেই মত গাইতে পারেন।
শ্রীললিতানন্দ নির্দিষ্ট সুর আরোপ করে বলে যান নি যে একমাত্র সেই সুরেই তাঁর গান গাইতে হবে। যার যেমন ভাব সে তেমন ভাবে এই গান গাইবে এই ছিল তাঁর নির্দেশ। যদি কেউ নিজে সুর দিতে চান ও সেই সুরে গান করেন তবে তিনি তা করতে পারেন। অনুরোধ, তা যাতে ভক্তিসঙ্গীতের মাহাত্ম্য ক্ষুণ্ণ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন।
**সেসময় যেভাবে গান গাওয়া হতো, তার নমুনা হিসেবে কয়েকটি অডিও প্রকাশ করা হলো, যেখানে কিছু বাণী এদিক ওদিক হয়েছে হয়তো । কিন্তু গাইবার সময় ওগুলি বই দেখে ঠিক করে নেবেন ।